সপ্তম অধ্যায় বিজ্ঞান-যোগ
কামৈস্তৈস্তৈর্হৃতজ্ঞানাঃ প্রপদ্যন্তেহন্যদেবতাঃ।
তং তং নিয়মমাস্থায় প্রকৃত্যা নিয়তাঃ স্বয়া।।
[ শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, অধ্যায় - ৭, শ্লোক - ২০ ]
অনুবাদঃ জড় কামনা-বাসনার দ্বারা যাদের জ্ঞান অপহৃত হয়েছে, তারা অন্য দেব-দেবীর শরণাগত হয় এবং তাদের স্বীয় স্বভাব অনুসারে বিশেষ নিয়ম পালন করে দেবতাদের উপাসনা করে।
তাৎপর্যঃ যারা সর্বতোভাবে জড় কলুষ থেকে মুক্ত হতে পেরেছে, তারাই পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণে আত্মসমর্পণ করে তাঁর প্রতি ভক্তিযুক্ত হয়। যতক্ষণ পর্যন্ত জীব জড় জগতের কলুষ থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত হতে না পারছে, ততক্ষণ সে স্বভাবতই অভক্ত থাকে। কিন্তু এমন কি বিষয়-বাসনার দ্বারা কলুষিত থাকা সত্ত্বেও যদি কেউ ভগবানের আশ্রয় অবলম্বন করে, তখন সে আর ততটা বহিরঙ্গা প্রকৃতির দ্বারা আকৃষ্ট হয় না; যথার্থ লক্ষ্যের প্রতি উত্তরোত্তর অগ্রসর হতে হতে সে শীঘ্রই সমস্ত প্রাকৃত কাম-বিকার থেকে সর্বতোভাবে মুক্ত হয়। শ্রীমদ্ভাগবতে বলা হয়েছে যে, সমস্ত জড় কামনা-বাসনা থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত শুদ্ধ ভক্তই হোক, অথবা প্রাকৃত অভিলাষযুক্ত হোক, অথবা জড় কলুষ থেকে মুক্তিকামীই হোক না কেন, সকলেরই কর্তব্য হচ্ছে বাসুদেবের শরণাগত হয়ে তাঁর উপাসনা করা। শ্রীমদ্ভাগবতে তাই বলা হয়েছে (২/৩/১০)—
অকামঃ সর্বকামো বা মোক্ষকাম উদারধীঃ ।
তীব্রেণ ভক্তিযোগেন যজেত পুরুষং পরম্ ।।
যে সব স্বপ্নবুদ্ধি মানুষের পারমার্থিক জ্ঞান অপহৃত হয়েছে, তারাই বিষয়-বাসনার তাৎক্ষণিক পূর্তির জন্য দেবতাদের শরণাপন্ন হয়। সাধারণত, এই স্তরের মানুষেরা ভগবানের শরণাগত হয় না, কারণ রজ ও তমোগুণের দ্বারা কলুষিত থাকার ফলে তারা বিভিন্ন দেব-দেবীর উপাসনার প্রতি অধিক আকৃষ্ট থাকে। দেবোপাসনার বিধি-বিধান পালন করেই তারা সন্তুষ্ট থাকে। বিভিন্ন দেব-দেবীর উপাসকেরা তাদের তুচ্ছ অভিলাষের দ্বারা এতই মোহাচ্ছন্ন থাকে যে, তারা পরম লক্ষ্য সম্পর্কে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ থাকে। ভগবানের ভক্ত কিন্তু কখনই এই পরম লক্ষ্য থেকে ভ্রষ্ট হন না। বৈদিক শাস্ত্রে ভিন্ন ভিন্ন উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ভিন্ন ভিন্ন দেব-দেবীকে পূজা করার বিধান দেওয়া আছে। যেমন, রোগ নিরাময়ের জন্য সূর্যদেবের উপাসনা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এর ফলে অভক্তেরা মনে করে যে, বিশেষ কোন উদ্দেশ্য সাধনের জন্য দেব-দেবীরা ভগবান থেকেও শ্রেষ্ঠ। কিন্তু ভগবানের শুদ্ধ ভক্ত জানেন যে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন সব কিছুর অধীশ্বর। শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে (আদি ৫/১৪২) বলা হয়েছে— একলে ঈশ্বর কৃষ্ণ, আর সব ভৃত্য। তাই, শুদ্ধ ভক্ত কখনও তাঁর বিষয়-বাসনা চরিতার্থ করবার জন্য দেব-দেবীর কাছে যান না। তিনি সর্বতোভাবে পরমেশ্বর ভগবানের উপর নির্ভরশীল এবং ভগবানের কাছ থেকে তিনি যা পান তাতেই তিনি সন্তুষ্ট থাকেন।
তথ্যসূত্র - শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা যথাযথ
0 Comments